মধ্যযুগীয় ভারতীয় বন্যা ও ভৌতিক কাহিনী ❤️
মধ্যযুগীয় ভারতের একটি দূরবর্তী শহর ছিল কুসুমপুর। এটি ছিল ঘন জঙ্গলের ভেতরে লুকানো, এক ছোট্ট শহর যেখানে দিন কেটেছিল মানুষদের সাধারণ জীবনযাত্রায়। কিন্তু একটি ঘটনা সেই শান্ত জনপদের ভাগ্যকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল।
কুসুমপুরের পাশে ছিল বিশাল এক নদী—উকড়ি বিল। নামটা বিল হলেও এটি ছিল মূলত নদী, যার পানি সাধারণত শান্ত ও ধীর ছিল। কিন্তু মধ্যযুগের এক শীতকালের পর, যে বর্ষা নেমেছিল তা ছিল মানুষের ধারণার বাইরে। মেঘ ঘন হয়ে এলো আকাশে, দিনের পর দিন পানি ঝরল একটানা। সেই পুরনো পাথরের বাড়িগুলো ও চাষের জমি ক্রমে পানির নিচে তলিয়ে যেতে শুরু করল।
শহরের মানুষরা ভয় পেল, কারণ উকড়ি বিল তখন আগ্রাসী দানবের মতো উঠছিল। বহু শতাব্দী ধরে এ শহর কোনো বড় দুর্যোগের সম্মুখীন হয়নি, তাই প্রতিরোধের কোনো উপায় ছিল না। শহরের হুজুর মককেল আলী তখন ঘোষণা করলেন, "এ কোনো সাধারণ বন্যা নয়। এটি সৃস্টিকর্তার অভিশাপ। শহরের পাপ আমাদের ডুবিয়ে দিচ্ছে।" হুজুরের কথায় মানুষের মনে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক, কারণ এ অঞ্চলের মানুষেরা বহুদিন ধরে একটি পুরনো কাহিনীতে বিশ্বাস করত—উকড়ির বিলে ভুতেরা বাস করে, যারা কোনো দুর্যোগ হলে আত্মা সংগ্রহ করে।
সেদিন রাতে যখন ঝড়ের তাণ্ডব চরমে পৌঁছল, শহরের এক প্রান্তের চাষী মককেল হুজুর তার স্ত্রী জরিনা বেগমের সাথে বাড়ির জানালা থেকে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাদের জমি, গবাদিপশু সব বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। তখনই হঠাৎ করে লরেন্স দেখতে পেল নদীর পানির ওপর দিয়ে এক অদ্ভুত মূর্তি ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রথমে মনে হলো কেবল পানির ঢেউ, কিন্তু পরে বুঝতে পারল সেটি একটি ফ্যাকাশে মানুষ-সদৃশ আকৃতি—এ যেন কোনো মৃত আত্মার প্রেত! তার চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারে, সারা শরীর পানি থেকে বেরিয়ে আসছিল।
মককেল তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে এলো। "ওই ভুতেরা আমাদের শেষ করতে এসেছে!" সে চিৎকার করে বলল। জরিনা তার স্বামীর কথায় বিশ্বাস করতে চাইল না, কিন্তু ভয় তারও মনের গভীরে ঢুকে গেল। তারা জানত শহরের মানুষদের সতর্ক করতে হবে।
পরের দিন শহরের সব মানুষ ভীতির চাদরে ঢেকে গেল। সবাই জানত উকড়ির বিলে বাস করা ভুতেরা বন্যার পানির সাথে ফিরে এসেছে। মককেল হুজুর তখন জোর দিয়ে বললেন যে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং ভুতদের ঠেকাতে বিশেষ মিলাদ অনুষ্ঠান করা হবে। রাতের বেলা শহরের প্রধান চত্বরে এক বিশাল আগুন জ্বালানো হলো, যেখানে সবাই জড়ো হলো প্রার্থনার জন্য।
কিন্তু মককেলের মনে সন্দেহ রয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল, সত্যিই কি সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ নাকি অন্য কোনো রহস্য এই বন্যার কারণ? সে সিদ্ধান্ত নিল শহরের বাইরে গিয়ে নদীর উৎস পর্যন্ত যাবে, কারণ সে বিশ্বাস করত এর পেছনে কোনো অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে। তার সাথে যোগ দিল আরো দুজন সাহসী যুবক—কালু মন্ডল এবং লম্বু তারা তিনজন ভোরবেলায় যাত্রা শুরু করল।
উকড়ির বিল ছিল ভয়ঙ্কর, তার পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে তারা নানা অদ্ভুত আওয়াজ শুনল। গাছের ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো তাদের চোখে পড়ল ফ্যাকাশে আকৃতি, যেগুলো যেন ছায়ার মতো তাদের অনুসরণ করছিল। নদীর উৎসের দিকে যেতে যেতে বৃষ্টি তীব্রতর হতে থাকল। একসময় তারা এসে পৌঁছল বিলের প্রধান উৎসে—এক বিশাল ঝর্ণার কাছে। কিন্তু সেখানে যা দেখল, তা তাদের অবিশ্বাস্য ঠেকল।
ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক বিশাল আকৃতির কালো মূর্তি—এক প্রাচীন দেবতার প্রতিমা। তার চারপাশে ঘুরছিল অদ্ভুত সব ফ্যাকাশে প্রেতাত্মা। মূর্তির দিকে তাকিয়ে কালু মন্ডল বলল, "এটাই নিশ্চয় ভুতদের কেন্দ্র। এই দেবতাই আমাদের শহরকে ধ্বংস করতে চাইছে।"
তারা বুঝল এই অদ্ভুত দেবতার প্রাচীন শক্তি বন্যার পেছনের কারণ। দেবতাকে ঠেকাতে তাদের কিছু একটা করতে হবে। মককেল সেই মূর্তির পাথরের মুখে তার হাতে থাকা কুঠার দিয়ে আঘাত করল। মূর্তির শরীর থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে শুরু করল, এবং সেই সাথে ঝড় আরো তীব্র হয়ে উঠল।
কিন্তু তখনই এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। ফ্যাকাশে প্রেতাত্মারা মূর্তির চারপাশ থেকে সরতে শুরু করল এবং ধীরে ধীরে তাদের শরীর গলে পানি হয়ে মাটিতে মিশে গেল। ঝড়ের দাপট কমে এল, এবং মূর্তি ভেঙে খান খান হয়ে পড়ল।
তারা তিনজন দ্রুত শহরে ফিরে এলো এবং সবাইকে জানাল যে দেবতা ও ভুতদের শক্তি ধ্বংস করা হয়েছে। হুজুর মককেল তখন প্রার্থনা শুরু করলেন শহরের শান্তি ফেরাতে। বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে লাগল, আর সেই সাথে শহরের মানুষদের মাঝে আবার স্বস্তি ফিরল।
তবে কুসুমপুরের মানুষদের মনে সেই ঘটনার স্মৃতি থেকে গেল। তারা জানল, উকড়ির বিলের গভীরে লুকিয়ে আছে প্রাচীন শক্তি, যা একদিন আবার ফিরে আসতে পারে। শহরের মানুষজন আগের চেয়ে আরো সচেতন হলো, এবং প্রতি বছর নদীর তীরে প্রার্থনা করতে শুরু করল যাতে এমন দুর্যোগ আর না আসে।
এভাবেই মধ্যযুগীয় কুসুমপুর শহরের লোকেরা বন্যা ও ভুতের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেল, কিন্তু তাদের বিশ্বাসে নতুন এক অধ্যায় যুক্ত হলো—প্রকৃতি আর অশুভ শক্তির মাঝে লড়াইয়ে মানুষের সচেতনতা ও বিশ্বাসই তাদের রক্ষা করতে পারে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন