রাতের অন্ধকারে ট্রেনটি যেন অজানা এক গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে। জানালার বাইরে কেবল কালো আকাশ আর অস্পষ্ট গাছপালা। ট্রেনের কেবিনে বসে থাকা আরিফের মনে বারবার এক অজানা শঙ্কা কড়া নাড়ছে। কোথাও কিছু একটা ঠিক নেই, তবে সেটা ঠিক কী—তা সে বুঝতে পারছে না।
সন্ধ্যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল আরিফ। জরুরি কাজে তাকে যেতে হবে। শুরুতে সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল, তবে ট্রেন ছাড়ার এক ঘণ্টা পর থেকেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। আশেপাশের যাত্রীরা একে একে নেমে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো নতুন যাত্রী উঠছে না। ট্রেনের আলো মৃদু হয়ে আসছে, আর এর সঙ্গে যেন ঘনিয়ে আসছে অদ্ভুত এক নীরবতা।
কেবিনে বসে থাকা একমাত্র অপরিচিত লোকটি হঠাৎ আরিফের দিকে তাকায়। তার চোখে অদ্ভুত এক শীতলতা। লোকটি হেসে বলল, "তোমার গন্তব্য কি তুমি জানো?"
এই প্রশ্নে আরিফ কাঁপতে থাকে। “হ্যাঁ, আমি ঢাকায় যাচ্ছি। আপনি কে?” আরিফ জিজ্ঞেস করে।
লোকটি মৃদু হেসে বলে, "সবাই ভাবে তারা জানে কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু সব গন্তব্য তো আর গন্তব্য নয়।"
কথাগুলো যেন আরিফের বুকের ভিতর হিমেল বাতাসের মতো বইতে থাকে। আরিফ জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, কিন্তু কেবল অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। আশেপাশের যাত্রীদের কেউ নেই, কেবিন প্রায় ফাঁকা। মনে হচ্ছিল, ট্রেনটি যেন এক অজানা পথের দিকে যাচ্ছে, যেখানে আলো পৌঁছায় না।
আরিফ আতঙ্কিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে ট্রেনের কন্ট্রোল কারে যেতে চায়, কিন্তু দরজা খুলতেই দেখতে পায় পুরো ট্রেন ফাঁকা—নিঃশব্দ। যেন ট্রেনের কোনো স্টেশন নেই, কোথাও থামার কোনো পরিকল্পনা নেই। কন্ট্রোল কারে পৌঁছাতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে, ট্রেন চালকও নেই। পুরো ট্রেনটি যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
হঠাৎ করে পেছন থেকে সেই লোকটির কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, "তোমার যাত্রা শেষ হয়ে আসছে।"
আরিফ পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু এবার লোকটি কেবিনে নেই। সে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্ধকার তার চারপাশ ঘিরে ধরছে, আরিফ পেছনে তাকিয়ে দেখে, কোনো পথ আর নেই।
হঠাৎ করে ট্রেনটি বিকট শব্দে থেমে যায়। আরিফ চারদিকে তাকায়, কিন্তু ট্রেনের বাইরে কিছুই দেখা যায় না। শুধু ধোঁয়ায় ঢাকা এক অজানা জায়গা। ট্রেনের দরজা খুলে যায়, আরিফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটি বলে, “এখানেই তোমার যাত্রা শেষ। তুমি তো নিজেই জানো না, আসলে কোথায় যাচ্ছিলে।”
আরিফের শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হতে থাকে। সে দরজার দিকে এগোতে চায়, কিন্তু যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রাখছে। তার পা নড়ছে না। লোকটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে, চোখে অদ্ভুত শীতলতা নিয়ে।
"তুমি এখানে থাকার জন্য বেছে নিয়েছ," লোকটি বলে।
আরিফ চিৎকার করে উঠে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর যেন হারিয়ে যায় ধোঁয়ার মধ্যে। সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, চারপাশের পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। ট্রেনের ভিতর থেকে বাহিরের সেই রহস্যময় ধোঁয়া ধীরে ধীরে কেবিনে ঢুকতে শুরু করে। আরিফ কিছু দেখতে পারছে না।
মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনটি আবার চলতে শুরু করে, আরিফ অজানার দিকে ছুটে যায়, আর রহস্যময় যাত্রা কখনো শেষ হয় না।
... PROTIC
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন