রিয়াদ ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখত বিদেশ যাওয়ার। তার বাবারমুখে শোনা ছিলো প্রবাসে থাকা আত্মীয়দের সফলতার গল্প। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি, জীবনের মানোন্নয়ন—এসবই ছিলো তার কাছে প্রবাসজীবনের মূলকথা। তবে তার দেশের প্রতি ভালোবাসা ছিলো অটুট। সবসময় ভেবেছিল, বিদেশ থেকে ফিরে এসে দেশের জন্য কিছু করবে। কিন্তু বাস্তবতা কি এমন সহজ?
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া রিয়াদের জীবনে সুযোগের সংকট ছিল চিরসঙ্গী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে সে কিছুদিন চাকরির চেষ্টা করে। কিন্তু দেশের কাজের বাজারে প্রতিযোগিতা এবং সীমিত সুযোগের কারণে সে বারবার ব্যর্থ হতে থাকে। একসময় সে সিদ্ধান্ত নেয়, পরিবারের আর্থিক অবস্থা বদলাতে তাকে প্রবাসেই যেতে হবে।
❤️প্রবাস যাত্রা
প্রথমদিকে, রিয়াদের পরিবার এবং বন্ধুরা তাকে উৎসাহ দিয়েছিল। সবাই বলত, "বাহ, রিয়াদ! বিদেশে গিয়ে নিজের জীবন পাল্টে ফেলো। আমাদের জন্য গর্বিত হয়ে উঠো।" এসব কথায় রিয়াদের প্রেরণা মিলত। কিন্তু বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে তার মনের গভীরে এক অজানা শূন্যতা ভর করে। দেশের মাটি, পরিচিত মানুষজন, প্রিয় শহর সবকিছুকে পেছনে ফেলে যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু বাস্তবতার কারণে তাকে মন শক্ত করতে হয়।
প্রথম যখন সে প্রবাসে পৌঁছায়, তখন চারপাশের নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন জীবন তাকে কিছুটা আচ্ছন্ন করে রাখে। ধীরে ধীরে সে নিজের কাজের মধ্যে ডুবে যায়। যদিও কাজটি তার পছন্দের ছিল না, তবুও পরিবারের জন্য অর্থ পাঠানোই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।
❤️প্রবাস জীবনের কঠোর বাস্তবতা
প্রথম কয়েক মাসে রিয়াদ বুঝতে পারে প্রবাসজীবন কতটা কঠিন। অজানা ভাষা, কৃষ্টি, এবং মানুষের মনোভাব তার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবার ও দেশের মানুষের থেকে দূরে থাকা—এটা রিয়াদের জন্য সহনীয় ছিল না। মাঝে মাঝে একাকীত্ব তাকে গ্রাস করত। যখনই সে দেশের মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা বলত, তখন তার হৃদয় ভারী হয়ে আসত। তার মনে হতো, যতটুকুই অর্থ উপার্জন করুক, এই বিচ্ছিন্ন জীবন তার জন্য কোনো অর্থ বহন করে না।
তার সবচেয়ে কষ্ট হতো যখন দেশে কোনো উৎসব হতো। ঈদ, পূজা কিংবা নতুন বছর—সবকিছুর সময় তার হৃদয় কেঁদে উঠত। ফোনের স্ক্রিনে দেশের উৎসবের ছবি বা ভিডিও দেখে তার মনে হতো, কেন সে এখানে? তার নিজের দেশ, নিজের মানুষ, মাটি—এসব কিছু ছেড়ে এই পরবাসে থেকে কি সত্যিই সে সুখী?
❤️দেশপ্রেমের অনুভূতি
একদিন কাজ শেষে ক্লান্ত রিয়াদ তার ঘরে ফিরে শুয়ে ছিল। হঠাৎ সে দেশের জাতীয় সংগীত শুনতে পায়। প্রবাসী বন্ধুদের নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত বাজছিল। সেই সংগীতের শব্দে রিয়াদের চোখ ভিজে যায়। তার দেশের মাটি, নদী, মানুষের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যায়—যেখানে সে প্রতিদিন দেশের মাটিতে হাঁটত, প্রিয় মানুষদের সঙ্গে হাসত, কথা বলত।
তার মনে প্রশ্ন জাগে, "আমি কেন এখানে? দেশের জন্য কিছু করার যে স্বপ্ন ছিল, তা কি আমি ভুলে গেছি?" একসময় রিয়াদ ঠিক করে, দেশে ফিরে যাবে এবং দেশের জন্য কিছু করবে। সে বুঝতে পারে যে শুধু টাকা পাঠানোই যথেষ্ট নয়, দেশের মাটিতে কিছু করা, দেশের মানুষের জন্য কিছু করা, সেটাই প্রকৃত দেশপ্রেম।
❤️দেশে ফেরা এবং সংগ্রাম
কয়েক বছর প্রবাসে কাটানোর পর, রিয়াদ শেষ পর্যন্ত দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবারের সবাই তাকে সমর্থন করে, যদিও কিছু আত্মীয়-স্বজন বিদেশে থেকে আরো বেশি অর্থ উপার্জনের পরামর্শ দেয়। কিন্তু রিয়াদের মনে ছিলো দেশের মাটিতে ফিরে গিয়ে কাজ করার ইচ্ছা।
দেশে ফিরে সে দেখল, এখানে ফিরে আসা যতটা সহজ ভেবেছিল, ততটা নয়। দেশের অর্থনীতি, রাজনৈতিক সমস্যা, এবং চাকরির বাজার—সবকিছুই তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবুও, সে তার মনোবল হারায়নি। বিভিন্ন চাকরির চেষ্টা করতে থাকে, পাশাপাশি দেশের কৃষি এবং প্রযুক্তি খাতে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করে।
কিছুদিন পর, রিয়াদ একটি কৃষিভিত্তিক প্রকল্প শুরু করে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রামের কৃষকদের উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। প্রথমদিকে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে তার প্রচেষ্টা সফল হতে শুরু করে। গ্রামের মানুষ তাকে সাহায্য করে, এবং কৃষি খাতে তার উদ্ভাবনী প্রকল্প সফল হতে থাকে।
❤️সাফল্য এবং নতুন দিগন্ত
প্রবাস থেকে ফিরে রিয়াদ দেশের জন্য যে কাজ শুরু করেছিল, তা ধীরে ধীরে সফলতা পেতে থাকে। গ্রামের কৃষকেরা তার প্রকল্প থেকে উপকৃত হতে থাকে। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, কৃষি উৎপাদন বেড়ে যায়, এবং দেশের অর্থনীতিতেও তার প্রকল্পের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
রিয়াদ বুঝতে পারে, অর্থ উপার্জন জীবনের মূল উদ্দেশ্য নয়। দেশের মানুষের জন্য কিছু করা, তাদের উন্নয়নে সহায়তা করা—এটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। প্রবাসের জীবন তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, কিন্তু দেশের মাটির টান তাকে নতুন করে জীবন বুঝিয়েছে।
❤️শেষ কথা❤️
রিয়াদ আজ প্রবাসীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। তিনি প্রমাণ করেছেন যে দেশের জন্য ভালো কিছু করার জন্য প্রবাসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের দেশেও একজন মানুষ উন্নয়ন ঘটাতে পারে, দেশকে এগিয়ে নিতে পারে। তার গল্পটি আমাদের শিখিয়ে দেয় যে দেশের প্রতি ভালোবাসা শুধু মুখের কথা নয়, বরং কাজের মাধ্যমেই তা প্রকাশ পায়।
দেশপ্রেম মানে শুধু দেশের মাটিতে বসে থাকা নয়, দেশের জন্য কিছু করা, দেশের মানুষকে ভালো রাখা। রিয়াদ বুঝতে পেরেছিল যে সত্যিকার দেশপ্রেম হচ্ছে নিজের দেশের মানুষের জন্য কাজ করা, তাদের জন্য কিছু ত্যাগ করা।
PROTIC
07.10.2024
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন